মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া
Table of Contents
আকিকার দিন তারিখ প্রসঙ্গ
এই ব্যাপারে দুইধরনের প্রান্তিকতা লক্ষ করা যায়। কিছু মানুষ আছে যারা ৭ম দিনে আকিকা করার প্রতি গুরুত্ব দেন না। ক্লিনিক, ডাক্তার, প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় টেষ্ট ইত্যাদির পিছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করলেও যৎসামান্য টাকা খরচ করে আকিকা করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ হাদিস শরীফে ৭ম দিনের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে নির্বাচিত সময়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয় না, কিন্তু শরীয়ত যে বিষয়ে কোনো দিন তারিখ নির্ধারিত করে দেয়নি সেখানে খুব তোড়জোড় করতে দেখা যায়। -আলমাদখাল ৩/২৯২-২৯৩
আবার কেউ কেউ ৭ম দিনে আকিকা করতে না পারলে মনে করে পরবতীর্তে আর আকিকা করা যায় না। অথচ মাসআলা হল,৭ম দিনে করতে না পারলে ১৪তম দিনে, তাও সম্ভব না হলে ২১তম দিনে আকিকা দিবে। -মুসতাদরাকে হাকিম ৪/২৩৮; ইলাউস্ সুনান ১৭/১১৬; আলমুগনী ১৩/৩৯৬
এটিও যদি সম্ভব না হয় তবে পরবর্তীতে যে কোনো দিন আকিকা করবে এবং এক্ষেত্রেও ৭-এর হিসাবের প্রতি লক্ষ রাখা যেতে পারে। এর সহজ নিয়ম হল, যে বারে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে তার আগের দিন আকিকা করা। যেমন সোমবারে জন্মগ্রহণ করলে রবিবারে আকিকা করা।
আকিকা না করে কুরবানী করা
এমনও শোনা যায় যে, আকিকা না হয়ে থাকলে তা আদায় করা পর্যন্ত নাকি কুরবানী দেওয়া যায় না। এ ধারণা ভুল। আকিকা দেওয়া না-দেওয়ার সাথে কুরবানীর কোনো সম্পর্ক নেই; বরং কারো আকিকা না হয়ে থাকলেও ওয়াজিব কুরবানী অবশ্যই আদায় করতে হবে। আর সম্ভব হলে আকিকাও দিবে।
দাওয়াত অনুষ্ঠান করে নাম দেওয়া হয় “আকিকা”
অনেকে সন্তানের জন্মগ্রহণকে কেন্দ্র করে দাওয়াত অনুষ্ঠান করে। হোটেল রেস্তোরাঁ কিংবা হল রুমগুলোতে চুক্তি করে খানার আয়োজন করা হয়। সেখানে গোস্তের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রেস্তোরাঁওয়ালাদের উপরই থাকে। এ অনুষ্ঠানকে যদিও আকিকা অনুষ্ঠান নাম দেওয়া হয় তবুও এতে আকিকার সুন্নত আদায় হবে না। শরীয়তের শেখানো পদ্ধতিতে পশু জবাইয়ের মাধ্যমেই আকিকা করতে হবে। -ইলাউস্ সুনান ১৭/১১৭; তুহফা ৭৫-৭৬
আজকাল আকিকা অনুষ্ঠানের রেওয়াজ বেড়েছে। কিন্তু খাইরুল কুরূনে আকিকাকে কেন্দ্র করে দাওয়াত করে খাওয়ানোর প্রচলন ছিল না। এ প্রথা পরবর্তী যুগের। এ অনুষ্ঠানে অনেক ধরনের শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ হতে দেখা যায়। এগুলো না থাকলেও আকিকাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান না করাই শ্রেয়। কেননা সাহাবা তাবেয়ীনের যুগে এর প্রচলন ছিল না। আকিকার গোস্ত কাঁচা বা রান্না করে গরীব-দুখী, আত্নীয়-স্বজনকে দিবে এবং নিজেরা খাবে। -আলমাদখাল ৩/২৯২; তুহফা ৮০,৭২; ইসলামী ফিকহ ২/১০৫-১০৬
আকিকা অনুষ্ঠানে উপঢৌকনের রেওয়াজ
আকিকা অনুষ্ঠানে বাচ্চার জন্য বিভিন্ন উপঢৌকন আনার প্রচলনটিও ঠিক নয়। কেননা এতে কারও মুখলজ্জায় পড়ে উপঢৌকন দেওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। আর এভাবে কেউ কোনো জিনিস দিলে তা নেওয়া ও ব্যবহার করা জয়েয হয় না। -মুসনাদে আহমদ ৫/১১৩
মা বাবার জন্য আকিকার গোশত খাওয়া
এ ধারণাও কেউ কেউ রাখে যে, মা বাবা সন্তানের আকিকার গোশত খেতে পারবে না। ফলে আকিকার গোস্ত মান্নতের মতো পুরোটাই বিতরণ করে দেওয়া হয়। এটা ঠিক নয়। আকিকার গোস্ত সন্তানের মা-বাবাও খেতে পারবে। -ইলাউস্ সুনান ১৭/১১৬; তুহফা ৭৮
আকিকার প্রাণীর চামড়া
আকিকার চামড়ার হুকুম কুরবানীর চামড়ার মতোই। কিন্তু অনেককে এ চামড়া কসাইকে পারিশ্রমিক হিসাবে দিয়ে দিতে দেখা যায। অনেকে আবার চামড়াটি বিক্রি করে তার মূল্য নিজে ভোগ করেন। এ সবই ভুল। আকিকার চামড়া কুরবানীর চামড়ার মতো ইচ্ছা করলে নিজেরা ব্যবহার করতে পারবে, তবে যদি তা বিক্রি করা হয় তাহলে এ টাকা গরীব-মিসকীনকে সদকা করে দেওয়া জরুরি। -তুহফা ৮২-৮৩; ইলাউস্ সুনান ১৭/১১৭; আল মাদখাল ৩/২৯২
আকিকার গোস্ত বণ্টন করা
অনেকে মনে করে আকিকার গোস্ত থেকে ফকীরদেরকে দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। এ গোস্ত আত্মীয়-স্বজন ও নিজেদের জন্য। এটি ভুল। আকিকার গোস্ত কুরবানীর গোস্তের মতোই ফকীর মিসকীনদের দেওয়ার নিয়ম আছে। -তুহফা ৭৯
আকিকার প্রাণী
অনেকে মনে করে, ছাগল ছাড়া আকিকা করা যায় না। এটি ভুল ধারণা। যে সব প্রাণী দ্বারা কুরবানী জায়েয সে সব প্রাণী দ্বারা আকিকাও জায়েয। এমনকি গরু মহিষ ও উটের এক সপ্তমাংশ দ্বারাও আকিকা করা যাবে। তবে শর্ত হচ্ছে ওই পশুর বাকি ছয় অংশও কুরবানী, আকিকা বা এ ধরনের পুণ্যের উদ্দেশ্যে হতে হবে। হাদীস শরীফে এসেছে, আনসারী সাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করলে উট জবাই করে আকিকা করা হয়েছিল। অবশ্য আকিকার জন্য গরু, মহিষ ও উটের চেয়ে ছাগল বা দুম্বাই উত্তম। -মুসতাদরাকে হাকেম ৪/২৩৮; তুহফা ৭৭; ইলাউস্ সুনান ১৭/১১৬-১১৭
নিজের আকিকার গোশত খাওয়া
সন্তান বড় হয়ে যাওয়ার পর তার আকিকা করা হলে ওই সন্তান নিজের আকিকার গোশত খেতে পারবে না ভাবা হয়। এটিও ভুল ধারণা।
একটি ভ্রান্তি
আকিকার দিনের একটি রেওয়াজ আছে যে, এদিনে সন্তানের হাতে কলম খড়ি দেওয়া হয়, দেওয়া হয় সোনা-রূপা ও টাকা-পয়সা। যেন বড় হয়ে সে পড়া-লেখা শিখে অনেক অর্থবিত্ত গড়তে পারে। এগুলোর সাথে শরীয়তের কোনোই সম্পর্ক নেই। এগুলো নিছক কু-রসম, যা পরিত্যাজ্য। -আলমাদখাল ৩/২৯০
আকিকার হুকুমকে গুরুত্ব না দেওয়া
অনেকে আকিকার প্রতি গুরুত্ব দেয় না, এটা ঠিক নয়। কেননা আকিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। একাধিক সহীহ হাদীসে এর প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।