জানাজার নামাজের নিয়ম= নামাযী সর্ব প্রথম প্রস্তুতি নিয়ে দাড়িয়ে মনে মনে জানাযার নামাযের নিয়ত করবে। ( নিয়ত পড়া বা নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা জরুরি না।)
এরপর অন্যান্য নামাযের মতই উভয় হাত কান অথবা কাঁধ বরাবর তুলবে। এর সাথে আল্লাহু আকবার” বলে তকবীর দেবে। অতঃপর ডান হাতকে বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর স্থাপন করবে।
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, ‘একদা আল্লাহর রসূল (ﷺ) এক জানাযার নামায পড়াকালে তকবীর দিলেন এবং প্রথম তকবীরের সময় তার উভয় হাতকে তুললেন। অতঃপর ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখলেন।” (তিরমিযী ১৯৭নং, সহীহ তিরমিযী ৮৫৯নং)
অতঃপর ‘আউযু বিল্লাহ, বিসমিল্লাহ’ পড়ে সুরা ফাতেহা পাঠ করবে। অতঃপর ‘বিসমিল্লাহ” বলে একটি (ছোট) সুরা পাঠ করবে।
তলহা বিন আবদুল্লাহ্ বিন আঊফ বলেন, আমি ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর পিছনে এক জানাযার নামায পড়লাম। তিনি উচ্চস্বরে আমাদেরকে শুনিয়ে সুরা ফাতেহা ও একটি অন্য সুরা পাঠ করলেন। অতঃপর নামায শেষ করলে আমি তার হাতে ধরে (উঁচু আওয়াজে পড়ার কারণ) জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি উত্তরে বললেন, ‘আমি উচ্চস্বরে এই জন্যই পড়লাম; যাতে তোমরা জানতে পার যে, উক্ত সূরা পাঠ সুন্নাহ (নবী (ﷺ) এর তরীকা) ও হক (সত্য)। (বুখারী শরীফ ১২৪৯, আকদাউদ ২৭৮৩ ক, তিরমিযী শরীফ ৯৪৭, ৯৪৮ক, নাসাঈ ১৯৬ ১ক ইবনুল জারুন, মুনতাফা ২৬৪নং)
সুতরাং উভয় সূরা চুপে-চুপে পড়াই হলো সুন্নত। তাই আবু উমামাহ সাহলও বলেন, জানাযার নামাযে সুন্নাহ হল, প্রথম তকবীরের পর আস্তে আস্তে সুরা ফাতেহা পাঠ করা। অতঃপর তিন তকবীর দেওয়া এবং শেষে সালাম ফেরা। (নাসাঈ ১৯৬৩ক)
অবশ্য শিক্ষাদান প্রভৃতির উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে পড়া দোষাবহ নয়। যেমন ইবনে আব্বাস (রাঃ) পড়েছিলেন। যেমন নবী (ﷺ) জানাযার দুআ উচ্চস্বরে পড়েছেন। যা শুনে সাহাবাগণ মুখস্থ করেছেন। উক্ত কিরাআতে সংক্ষিপ্ত সুরা পড়াই বাঞ্ছনীয়। কারণ, জানাযা সমস্ত কাজই তড়িঘড়ির উপর সমাধা করা কর্তব্য। আর এ জন্যই এ নামাযে ইস্তিফতাহর দুআ পাঠ বিধেয় নয়। (সাবউনা সুআলান ১২পৃঃ)
ছোট একটি সুরা পাঠ শেষ হলে নামাযী দ্বিতীয় তকবীর দেবে। এই তকবীর এবং এর পরের তকবীরগুলোতে হাত তোলার প্রসঙ্গে নবী (ﷺ) হতে কিছু প্রমাণিত নেই। আর প্রথম তকবীর ছাড়া অন্যান্য তকবীরের সময় তিনি হাত তুলতেন না বলে যে হাদীস আছে, তা শুদ্ধ নয়। পক্ষান্তরে ইবনে উমার, ইবনে আব্বাস ও আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তাঁরা সকল তকবীরে হাত তুলতেন। (নাইলুল আউতার ৪/৬২) অতএব সাহাবাদের এই আমলকে সুন্নাহ ধরে নিয়ে প্রত্যেক তকবীরের সময় হাত তোলা উত্তম বলা যায়। কারণ, তারা নবী (ﷺ) কে অনুরূপ হাত তুলতে দেখেছেন বলেই তাদের আমল ঐরূপ ছিল। নচেৎ উক্ত আমল তাঁদের নিজস্ব ইজতিহাদও বলা যায় না। তবে যদি এ কথা কেউ না মানেন, তাহলে হাত না তোলাতেও কোন দোষ নেই।
অতঃপর নামাযী বুকের উপর হাত রেখে নবী (ﷺ) এর উপর দরূদ পাঠ করবে। সেই ইব্রাহীমী দরূদ পাঠ করবে যা নামাযের তাশাহহুদে পাঠ করা হয়ে। থাকে। (দেখুন, বাইহাকী ৪/৩৯, ইবনুল জারূদ ২৬৫ নং, প্রমুখ।)
অতঃপর তৃতীয় তকবীর বলে (দুই হাত না তুলে অথবা তুলে পুনরায় হাত বুকে রেখে) মাইয়্যেতের জন্য বিশুদ্ধচিত্তে ও আন্তরিকতার সাথে দুআ করবে। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, তোমরা যখন মাইয়্যেতের জানাযা পড়বে তখন তার জন্য উত্তমরূপে দুআ করবে। (আবু দাউদ ২৭৮৪ক, ইবনে মাজাহ ১৪৮৬)।
সেই দুআ পাঠ করবে যা মহানবী (ﷺ) হতে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত। যেমনঃ
২২৮৫০ক)
প্রকাশ থাকে যে, উক্ত দুআটি পুরুষ মাইয়্যেতের জন্য ব্যবহৃত। কারণ, নবী (ﷺ) পুরুষের জন্যই পড়েছিলেন। মহিলার জন্যও পড়া বৈধ। তবে এ ক্ষেত্রে যদি তার স্বামী বেদীন হয় তবেই পূর্ণ দুআ বলা যাবে। নচেৎ “অযাউজান খাইরাম মিন যাওজিহ” (অর্থাৎ ওর পার্থিব জুড়ি অপেক্ষা উৎকৃষ্ট জুড়ি দান কর) বাক্যটি বাদ দিয়ে পড়তে হবে। কারণ, স্বামী নেক হলে এবং উভয়ে জান্নাতে গেলে স্ত্রী উক্ত স্বামীরই অধিকারে থাকবে। (আল-বিজাযাহ)
পরেও দুআ পড়ার কথা প্রমাণিত।) (দেখুন, বাইহাকী ৪/৩৫, হাকেম ১/৩৬০, আহমাদ ৪/৩৮৩, ইবনে মাজাহ ১৫০৩নং, সহীহ ইবনে মাজাহ ১২২০নং)
অতঃপর চতুর্থ তাকবীর বলে সাধারণ নামাযে সালাম ফেরার মত ডানে ও বামে সালাম ফিরাবে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, তিনটি কাজ এমন আছে যা আল্লাহর রসূল (ﷺ) করতেন কিন্তু লোকেরা তা বর্জন করেছে; এর মধ্যে একটি হল (অন্যান্য) নামাযের মত জানাযার নামাযে সালাম ফেরা।’ (বাইহাকী ৪/৪৩, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/৩৪}
অবশ্য এক দিকে (কেবল ডাইনে) সালাম ফেরাও যথেষ্ট। কারণ, আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) এক জানাযার নামায পড়লেন। তিনি তাতে চার তকবীর দিলেন এবং শেষে একটি মাত্র সালাম ফিরলেন।
মুক্তাদী হলে এবং ইমাম উচ্চস্বরে কিরাআত পড়লে সুরা ফাতিহা পাঠ করবে। আর অন্য একটি সূরা পাঠ না করে ইমামের কিরাআত শুনবে।
আয়োজনকে এবং লোকদের জমায়েতকে আমরা জাহেলিয়াতের মাতম হিসাবে গণ্য করতাম। (যা ইসলামে হারাম।) (আহমাদ ৬৯০৫নং, ইবনে মাজাহ ১৬১২নং, সহীহ ইবনে মাজাহ ১৩০৮নং)
জানাজার নামাজের নিয়ম
প্রশ্ন :
মানুষ মারা গেলে মাইকে কিংবা মোবাইলে সংবাদ প্রচার করা যাবে কি না?
উত্তরঃ মোবাইলে সংবাদ দেয়া যাবে। তবে মাইকে প্রচার করা যাবে না। কারণ মাইক ও মোবাইলে সংবাদ প্রচার এক নয়। মাইকের মাধ্যমে সকল জনতার কাছে শোক সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এটা ‘নাঈ’ অর্থাৎ বিলাপ হিসাবে গণ্য হবে। হাদীছে শোক সংবাদ প্রচার করতে নিষেধ করা হয়েছে (ছহীহ তিরমিযী হা/৯৮৬, সনদ হাসান)। হাদীছে এসেছে সংবাদ জানিয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য আবেদন করে সংবাদ দিতে পারে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নাজাশীর মৃত্যু সংবাদ প্রচার করেছেন (বুখারী হা/১২৪৫; মুসলিম হা/৯৫১)।
প্রশ্ন:
মাইয়্যেতের জন্য কতদিন পর্যন্ত জানাজার নামাজ আদায় করা যাবে?
উত্তর : কেউ মারা গেলে এবং তার জানাযায় অংশগ্রহণ করতে না পারলে তার কবরকে সামনে রেখে একাকী বা জামা‘আতের সাথে মাইয়েতের জন্য যে কোন দিন জানাযার নামাজ আদায় করা যাবে। রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ একাধিক কবরের উপর জানাযার ছালাত আদায় করেছেন (বুখারী)
প্রশ্ন:
এক লাশের জন্য একাধিক স্থানে জানাযা করা যাবে কি-না?
উত্তর : প্রয়োজনে একাধিক স্থানে জানাযা করাতে বাধা নেই। (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/১৬৫৮; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৫/২৬৬-৬৭; আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃ. ৪৭১)। তবে বর্তমানে জনপ্রিয় মানুষদের লাশ জানাযার উদ্দেশ্যে বহু স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, যা ঠিক নয়। কেননা তা রাসূল (ছাঃ)-এর দ্রুত দাফন-কাফনের নির্দেশনা বিরোধী হয়। আব্দুর রহমান বিন আবুবকর (রাঃ) হাবশায় মৃত্যুবরণ করলে তার লাশ মক্কায় আনা হয়। সেটা দেখে তার বোন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! যদি আমি সেখানে থাকতাম, তাহলে আমি তোমাকে সেখানেই দাফন করতাম’ (আল-বিদায়াহ ৮/৮৯) তবে প্রয়োজনে লাশ স্থানান্তর করাতে বাঁধা নেই। যেমন সা‘দ বিন আবু ওয়াক্কাছ ও সাঈদ বিন যায়েদ (রাঃ)-এর লাশ (মক্কা প্রদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা) আক্বীক্ব থেকে মদীনায় আনা হয়। ইবনু উয়ায়না বলেন, ইবনু ওমর (রাঃ) আক্বীক্বে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি অছিয়ত করেন, যেন তাকে (মক্কা থেকে ৬ কি.মি. উত্তরে তানঈম-এর নিকটবর্তী) ‘সারিফে’ দাফন করা হয় (ইবনু কুদামাহ ২/৩৮০ পৃ., মাসআলা ক্রমিক : ১৫৯৮)।
প্রশ্ন :
আমাদের এলাকার এক ভদ্র হিন্দু শিক্ষক মারা গেলে হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলে তাঁকে দাফন করে। এ ব্যাপারে শরীয়তের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বাধিত করবেন।
উত্তরঃ কোন অমুসলিমকে যদি দাফন করার কেউ না থাকে তবে মুসলিমগণ তাকে দাফন করতে পারে। (আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইরওয়া হা/৭১৭)। তবে মুসলিম ব্যক্তির জন্য স্বেচ্ছায় সেখানে না যাওয়াই ভাল। কারণ জানাযা ও কাফন-দাফনের বিষয়টি শুধু এক মুসলিম অপর মুসলিমের প্রতি হক রাখেন (নাসাঈ, মিশকাত হা/৪৬৩০ ‘সালাম’ অনুচ্ছেদ)।
প্রশ্ন:
ভ্রূণ নির্গত হ’লে তার জানাযার ছালাত পড়তে হবে কি?
উত্তর : কান্নার শব্দ, জীবনের প্রমাণ পাওয়া বা হাঁচি না দিলে জানাযা পড়া যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যখন ভূমিষ্ট নবজাতক চিৎকার করবে, তখন তার উপর জানাযা পড়া হবে এবং সে ওয়ারিছ হবে
প্রশ্ন :
জানাযার নামাজ পড়াতে গিয়ে ইমাম ভুল করলে করণীয় কী? এই ভুলের জন্য মুক্তাদী দায়ী হবে কি?
উত্তর : ইমাম ভুল করে নামাজ শেষ করলে তার জন্য আর কিছু করণীয় নেই। কারণ জানাযার ছালাতে কোন লোকমা নেই (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২০৭ পৃঃ)। তাই ইমাম-মুক্তাদী কেউ দায়ী হবেন না।