আন্দোলন-পরবর্তী বাংলাদেশ কেমন হবে, সে নিয়ে অনেকেই অনেক রকম কথা বলছেন। বিশেষত ‘ইনক্লুসিভ’ ও ‘পোস্টইডিউলজির’ কথা বারবার ঘুরে ফিরে আসছে। সহজ বাংলায় বললে, কীভাবে অতীতের মতাদর্শিক বিবাদকে অতিক্রম করে আমরা একটা ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারি, এই ভাবনা থেকেই এসব প্রস্তাবনার সূত্রপাত। উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক, আমি এসব কল্পনা ও পরিকল্পনাকে সমর্থন করি না।

বাংলাদেশে প্রথাগত জাতীয়তাবাদ ও সেকুলারিজম ফেইল করেছে। কেন ফেইল করল, সেটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না—নয়ত আমার একই ভুল বারবার করতে থাকব। বাংলাদেশে হিন্দু ও ‘লিবারেল’ মুসলমানের সংখ্যা মোটেই কম নয়, বামপন্থী গোষ্ঠীগুলোও যথেষ্ট প্রভাবশালী; কাজেই, ধর্মভিত্তিক যে কোন উদ্যোগ জাতীয় ঐক্যকে বিনষ্ট করবে—এই ছিল প্রথাগত জাতীয়তাবাদ ও সেকুলারিজমের প্রধান যুক্তি।

জুলাই আন্দোলনের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগ কী কী শ্লোগান দিয়েছিল, সেগুলো আশা করি আপনারা ভুলে যাননি। ‘আমি কে, তুমি কে? বাঙালি বাঙালি’/ ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, এই শ্লোগানগুলোকে কি আপনার কোনভাবে মতাদর্শিক বা গোষ্ঠীতান্ত্রিক শ্লোগান বলে মনে হয়? আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, শাহাবাগেও কিন্তু একই রকম শ্লোগান দেওয়া হয়েছিল। কাজেই, জাতীয় ঐক্যের কল্পনা যতই মহৎ হোক, আপনারা আবার অতীতের ভুল রিপিট কইরেন না।

প্রশ্ন হল, ভারতে সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে সাধারণত পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ঐক্যমত বিরাজ করে। রাহুল গান্ধী গণতন্ত্রের শ্লোগানে দুনিয়া গরম করে ফেললেও বাংলাদেশ প্রশ্নে মোদীর বিজেপির সাথে তাদের কোন দ্বিমত নেই। শশি থারুরকে আপনার যতই ‘লিবারেল’ মনে হোক, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বিজেপির সাথে থারুরদের কোন বিরোধ নেই। বাংলাদেশে আমরা কীভাবে এমন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারব? আমার কাছে মনে হয়, এটার উত্তর একটাই।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে রাজনৈতিক ও বৈদেশিক প্রভাবের ভূত দূর করতে হবে, পাশাপাশি নিয়মিত সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। প্রয়োজনে এই মেয়াদকে পাঁচ বছর থেকে চার বছরে নামিয়ে আনা যেতে পারে। যদি এভাবে চার-পাঁচটি নির্বাচন আয়োজন করা যায়, তবে মৌলিকভাবে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। আগে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে তারপর নির্বাচন—এমন কল্পনা যতই মহৎ হোক, এটি অত্যন্ত বিপদজনক। মানুষ যত খুশী মতাদর্শিক চর্চা করুক, গোষ্ঠী কেন্দ্রিকতা করুক, তাতে আমি কোন অসুবিধা দেখি না—আমি বরং এসবে উৎসাহ দেই, আপনার স্বার্থ আপনার নিজেকেই দেখতে হবে, সবাই নিজের স্বার্থ আদায় করতে জানলে এটাই একটা ফেয়ার পলিটিকাল সিস্টেম। কিন্তু ইনক্লুসিভটির নামে যতই জাতীয় ঐক্য করেন, কোন পলিটিকাল সিস্টেম গড়ে ওঠবে না।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যারা স্বাধীন করেছেন, তাদের অধিকাংশই খলনায়ক ও স্বৈরাচার হিসেবে পরিচিত। আপনারা হয়ত শুধু শেখ মুজিবকেই চিনেন। তবে এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। মিসরের জামাল আব্দুন নাসের, আলজেরিয়ার হুয়ারি বুমেদিন, তিউনিসিয়ার হাবিব বুরগিবা—আরও অনেকে। পশ্চিমা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যেমন বলা হয়, বাজারই দ্রব্যমূল্য ঠিক করে দিবে, যোগান-চাহিদাতেই ঠিক হবে সবকিছু। একইভাবে পশ্চিমা গণতন্ত্রের মূলকথা এটাই—জাতীয় ঐক্য-মতাদর্শ-আদর্শ-নীতি ঠিক কেমন হবে, সেটা জনগণই ঠিক করে দিবে। যদি আগে থেকেই আদর্শ ঠিক করে দেওয়া যায়, তাহলে তো ভোটের কোন দরকার নাই—ঠিক করা যায় না দেখেই নির্বাচন জরুরী।

জাতীয়তাবাদী-বামপন্থী কায়দায় জাতীয় ঐক্য চাপিয়ে দেবার স্মৃতিগুলো খুব একটা সুখকর নয়। Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely.

লেখা: ইফতেখার জামিল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *