আজকের আলোচনা ফিতরা কার উপর ওয়াজিব? কখন ওয়াজিব? এবং কতো ওয়াজিব? তাহলে চলুন শুরু করা যাক।
ফিতরা কার উপর ওয়াজিব
প্রয়োজন অতিরিক্ত নেশা পরিমান সম্পদের মালিক হলে সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে। ফিতরার নিসাব জাকাতের নিসাবের সমপরিমাণ। অর্থাৎ কারো কাছে সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে ৫২ ভরি রুপা অথবা তার সমমূল্যের নগদ অর্থ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অতিরিক্ত সম্পদ ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় বিদ্যমান থাকলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে। যাঁর ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব, তিনি নিজের পক্ষ থেকে যেমন আদায় করবেন, তেমনি নিজের অধীনদের পক্ষ থেকেও আদায় করবেন। তবে এতে জাকাতের মতো বর্ষ অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়। (ফাতহুল ক্বাদির : ২/২৮১)
এমনকি পবিত্র রমজানের শেষ দিনেও যে নবজাতক দুনিয়ায় এসেছে কিংবা কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে, তার পক্ষ থেকেও সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। (ফাতাওয়া আলমগিরি : ১/১৯২)
সদকাতুল ফিতর কী?
এর উত্তর হলো- সদকাতুল ফিতর-এ দুটি আরবি শব্দ। সদকা মানে দান আর ফিতর মানে রোজার সমাপন বা ঈদুল ফিতর। অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের দিন আদায় করা সদকাকেই সদকাতুল ফিতর বলা হয়। এটিকে জাকাতুল ফিতর বা ফিতরাও বলা হয়ে থাকে।
শরিয়ত মতে, সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেছেন। এর পরিমাণ হলো- এক সা জব বা এক সা খেজুর। ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন সবার ওপরই এটি ওয়াজিব।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ১৫১২)

সদকাতুল ফিতর কেন দিতে হয়?
জাকাতের মতো সদকাতুল ফিতরও একটি আর্থিক ইবাদত। পবিত্র মাহে রমজানে সিয়াম পালন করতে গিয়ে সাধারণত আমাদের অনেক ভুলত্রুটি হয়ে যায়। সেই ত্রুটিবিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ হিসেবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত একটি ইবাদতের নাম সদকাতুল ফিতর। এটি পরম করুণাময় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পবিত্র উপহারও বটে।
সদকাতুল ফিতরের উদ্দেশ্য শুধু “গরিবদের ঈদের খুশিতে শরিক করা” বলে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে, তা যথার্থ নয়। কেননা হাদিস শরিফে সদকাতুল ফিতরকে কাফফারাতুন লিসসাওম, অর্থাৎ রোজা অবস্থায় অবচেতনভাবে যে ত্রুটিবিচ্যুতি হয়ে যায়, তার কাফফারা বা ক্ষতিপূরণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ?
এর পরিমাণ সম্পর্কে শরিয়তে দুটি মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা হচ্ছে ‘এক সা’ বা ‘নিসফে সা’। খেজুর, পনির, যব ও কিশমিশ দ্বারা আদায়ের ক্ষেত্রে এক ‘সা’=৩২৭০.৬০ গ্রাম (প্রায়), অর্থাৎ তিন কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি। এ ছাড়া গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে ‘নিসফে সা’=১৬৩৫.৩১৫ গ্রাম বা ১.৬৩৫৩১৫ কেজি (প্রায়), অর্থাৎ এক কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি প্রযোজ্য হবে। (আওজানে শরইয়্যাহ, পৃষ্ঠা : ১৮)
খাদ্যের বদলে মূল্য দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায়
রাসুল (সা.)-এর যুগে মোট চারটি পণ্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা হতো। খেজুর, কিশমিশ, যব ও পনির। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমরা এক সা পরিমাণ খাদ্য অথবা এক সা পরিমাণ যব অথবা এক সা পরিমাণ খেজুর অথবা এক সা পরিমাণ পনির অথবা এক সা পরিমাণ কিশমিশ দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম। (বুখারি, হাদিস : ১৫০৬)
উল্লিখিত খাদ্যবস্তুর পরিবর্তে সেগুলোর কোনো একটিকে মাপকাঠি ধরে তার মূল্য আদায় করলেও তা আদায় হয়ে যাবে। মূল্যের দিক থেকে ওই খাদ্যবস্তুগুলোর মধ্যে তফাত থাকলেও সবচেয়ে কম দামের বস্তুকে মাপকাঠি ধরে যদি কেউ ফিতরা আদায় করে দেয়, তাহলেও তা আদায় হয়ে যাবে।
বর্তমান বাজারদর হিসাবে যেহেতু গমের দামই সবচেয়ে কম, তাই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর আধা ‘সা’ গমকে মাপকাঠি ধরে ওই সময়ের বাজারদর হিসাবে তার মূল্য ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ ঘোষণা করা হয়। এ বছর সর্বনিম্ন ৭৫ টাকা। তবে এর মানে এই নয় যে ধনীরাও তাদের ফিতরা ৭৫ টাকাই আদায় করবে। উত্তম হলো, নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী বেশি মূল্যের খাদ্যবস্তুকে মাপকাঠি ধরে ফিতরা আদায় করা। কেননা সদকার মূল লক্ষ্যই হলো- গরিবদের প্রয়োজন পূরণ ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ।
এছাড়া আদায়কারীর সামর্থ্যকেও বিবেচনায় রাখা উচিত, যদিও শরিয়তে সর্বনিম্ন মূল্যে ফিতরা আদায় করার দরজা খোলা রাখা হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে যব, কিশমিশ, খেজুর ও পনিরের হিসাবে ফিতরার আলাদা মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কেউ চাইলে আটার হিসাবে ফিতরা না দিয়ে উল্লিখিত জিনিসগুলোর হিসাবেও ফিতরা দিতে পারবে।
সদকাতুল ফিতর আদায়ের সময়?
পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম। তবে জাকাতের মতো সে সময়ের আগে রমজান মাসেও তা আদায় করা যায়।

ফিতরার বিধান কি?
ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তা মুসলিমদের ওপর আবশ্যক করেছেন।
এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হুকুম মান্য করল, সে আল্লাহর হুকুমই মান্য করল। আর যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল, আমি আপনাকে তাদের জন্য পর্যবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি। ’ -সূরা আন নিসা: ৮০
যাদের ওপর ফিতরা আবশ্যক
মাসয়ালা : প্রত্যেক স্বাধীন মুসলমানের ওপর ফিতরা আদায় কার ওয়াজিব। যার কাছে ঈদের দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য (ঘর, কাপড়, গাড়ি ইত্যাদি)-এর অতিরিক্ত সম্পদ থাকবে, তার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। এক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া শর্ত নয়। -আল জাওহারাতুন নিয়ারাহ: ১/১৭০
মাসয়ালা : সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য ওই পণ্য বছরকাল থাকা আবশ্যক নয়। ফিতরা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের পক্ষ থেকে পিতা আদায় করবেন। যে ব্যক্তি ওজরবশত বা গাফলত করে রোজা রাখেনি তাকেও সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে। –আল জাওহারাতুন নিয়ারাহ: ১/১৭০
মাসয়ালা : যে ব্যক্তি মালিকে নেসাব সে যদি ঈদের দিনে সুবহে সাদেকের সময়টুকু পায় তাহলে তার ওপর ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। এতে বুঝা যায়, যদি কোনো ব্যক্তি ঈদের দিন সুবহে সাদেকের পূর্বে মারা যায়, তাহলে তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। এভাবে যদি সুবহে সাদেকের পরে কোনো বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে তার পক্ষ থেকেও ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। তবে যদি কোনো ব্যক্তি সুবহে সাদেকের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করে বা কোনো বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে তাহলে তাদের ওপরও ফিতরা ওয়াজিব। -ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া: ২/৪১৭; ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি: ১/১৯২

ফিতরা আদায়ের সময়
সদকাতুল ফিতর আদায়ের সময় দু’ধরণের- ১. ফজিলতপূর্ণ সময় ও ২. সাধারণ সময়।
১. ফজিলতপূর্ণ সময়:
ঈদের দিন সকালে ঈদের নামাজের পূর্বে। বোখারিতে বর্ণিত, আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমরা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে সদকাতুল ফিতর হিসেবে ঈদুল ফিতরের দিন এক সা’ পরিমাণ খাদ্য আদায় করতাম।
সুতরাং ঈদুল ফিতরের নামাজ একটু বিলম্বে আদায় করা উত্তম। যাতে মানুষ সদকাতুল ফিতর আদায় করতে পারে।
২. জায়েজ সময়
ঈদের একদিন দু’দিন পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করা। তখন তা ওয়াজিব হিসেবেই আদায় হয়ে যাবে। তবে ঈদের দিন ঈদের নামাজের পূর্বেই আদায় করা মোস্তাহাব। যদি কোনো কারণবশতঃ ঈদের নামাজের পূর্বে আদায় করতে না পারে তাহলে পরে হলেও আদায় করা ওয়াজিব; এটা কখনো নফলে পরিণত হবে না। -হেদায়া: ১/২০৮
মাসয়ালা : ঈদের কতদিন পূর্বে ফিতরা আদায় করা যাবে? এ বিষয়ে ইসলামি স্কলারদের মতভেদ থাকলেও গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে, রমজানের পূর্বে আদায় করলেও ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। এমনকি কয়েক বছরের ফিতরা একত্রে আদায় করলেও তা আদায় হবে। -ফাতাওয়ায়ে শামি: ২/৩৬৭
সদকাতুল ফিতর প্রদানের স্থান
মাসয়ালা : সদকাতুল ফিতর প্রদানের সময় যে এলাকায় সে অবস্থান করছে ওই এলাকার গরীবরাই বেশি হকদার। ওই এলাকায় সে স্থায়ী হোক বা অস্থায়ী। কিন্তু যদি তার বসতি এলাকায় কোনো হকদার না থাকে বা হকদার চেনা অসম্ভব হয়, তাহলে তার পক্ষে উকিল নিযুক্ত করবে। সে উপযুক্ত ব্যক্তি খুঁজে তার সদকাতুল ফিতর আদায় করে দিবে।

সদকাতুল ফিতরের হকদার
মাসয়ালা : সদকাতুল ফিতর হকদার হচ্ছে-
১. দরিদ্র, ২. ঋণ আদায়ে অক্ষম, ৩. ঋণগ্রস্ত, তাকে প্রয়োজন পরিমাণ দেয়া যাবে।
এক সদকাতুল ফিতর অনেক ফকিরকে দেয়া যাবে এবং অনেক সদকাতুল ফিতর এক মিসকিনকেও দেয়া যাবে। -দুররে মুখতার: ২/৩৬৭
সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ
বর্ণিত এ দু’টি হাদিস থেকে বোঝা যায়, কোনো খাদ্যবস্তু দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে এবং এর পরিমাণ হলো এক সা’। যার বর্তমান বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এ বছর জনপ্রতি সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা, সর্বোচ্চ ২৬৪০ টাকা।
মাসয়ালা : ইসলামি শরিয়া মতে আটা, খেজুর, কিসমিস, পনির ও যব ইত্যাদি পণ্যগুলোর যে কোনো একটির মাধ্যমে ফিতরা প্রদান করা যায়। আটার মাধ্যমে ফিতরা আদায় করলে জনপ্রতি এক কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য আদায় করতে হবে। খেজুরের মাধ্যমে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য, কিসমিসের মাধ্যমে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য, পনির দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য এবং যব দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য দিয়ে ফিতরা আদায় করতে হবে।
লেখক: মুফতি কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক
সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা কি ওয়াজিব
সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের গুরুত্ব