দোয়া কুনুতকে মূল্যবান দোয়াগুলোর মধ্যে থেকে অন্যতম মনে করা হয়। এটি বিতর নামাজের তৃতীয় রাকাতে সুরা ফাতিহার সঙ্গে সুরা মিলানোর পর পাঠ করতে হয়। এই দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে গুরুত্বপূর্ণ আবেদনগুলো তুলে ধরা হয়। দোয়া কুনুত রাসুল (সা.) মাঝে মাঝে পাঠ করতেন।
দোয়া কুনুত কি
বিতরের নামাজের তৃতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহার সাথে সূরা মিলিয়ে তাকবিরের সাথে যে দোয়া পাঠ করা হয় তা হল দোয়া কুনুত। এই প্রার্থনায় আল্লাহর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুরোধ রয়েছে। হানাফি মাজহাব মতে বিতর নামাজে দোয়া কুনুত পড়া ওয়াজিব।
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে সুরা-কেরাত, দরুদ, তাশাহুদ, দোয়ায়ে মাসুরাসহ বিভিন্ন দোয়া পড়া হয়। নামাজে এসব পড়া আবশ্যক। এমন দোয়ার মতো আরেকটি আমল হল- দোয়া কুনুত।
দোয়া কুনুত আরবি :
اَللَّهُمَّ اِنَّ نَسْتَعِيْنُكَ.وَنَسْتَغْفِرُكَ.وَنُؤْمِنُ بِكَ.وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْكَ وَنُثْنِىْ عَلَيْكَ الْخَيْرَ. وَنَشْكُرُكَ وَلاَ نَكْفُرُكَ. ونَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَّفْجُرُكَ اَللَّهُمَّ اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَلَكَ نُصَلِّىْ. ونَسْجُدُ وَاِلَيْكَ نَسْعَى. وَنَحْفِدُ وَنَرْجُوْ رَحْمَتَكَ. وَنَخْشَى عَذَابَكَ اِنَّ عَذَابَكَ بِالْكُفَّارِ مُلْحِقٌ
দোয়া কুনুতের আরবি উচ্চারণ
আল্লাহুম্মা ইন্না নাসতায়িনুকা ওয়া নাসতাগ ফিরুকা, ওয়ানু’মিনু বিকা ওয়া নাতাওয়াক্কালু আলাইকা ওয়া নুছনি আলাইকাল খাইর। ওয়া নাসকুরুকা ওয়ালা নাক ফুরুকা, ওয়ানাখলাউ উয়ানাত রুকু মাইয়্যাফযুরুকা। আল্লাহুম্মা ইয়্যাকানা’বুদু ওয়ালাকা নুছল্লি, ওয়ানাস জুদু ওয়া ইলাইকা নাসআ, ওয়া নাহ্ফিদু অ নারজু রাহমাতাকা, ওয়া নাখশা আজাবাকা ইন্না আযাবাকা বিলকুফ্ফারি মুলহিক্।
দোয়া কুনুতের বাংলা অর্থ
হে আল্লাহ! আমরা তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। তোমারই নিকট ক্ষমা চাই, তোমারই প্রতি ঈমান রাখি, তোমারই উপর ভরসা করি এবং সকল ভালাই তোমারই দিকে ন্যস্ত করি। আমরা তোমার কৃতজ্ঞ হয়ে চলি, অকৃতজ্ঞ হই না। হে আল্লাহ! আমরা তোমারই দাসত্ব করি, তোমারই জন্য নামাজ পড়ি এবং তোমাকেই সিজদাহ করি। আমরা তোমারই দিকে দৌড়াই ও এগিয়ে চলি। আমরা তোমারই রহমত আশা করি এবং তোমার আযাবকে ভয় করি। আর তোমার আযাবতো কাফেরদের জন্যই র্নিধারিত।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি একরাতে নবী (সা.)-এর নিকটে ছিলাম। তিনি শয্যাত্যাগ করলেন এবং দুই রাকাত নামাজ পড়লেন। এরপর উঠে বিতর পড়লেন। প্রথম রাকাতে ফাতিহার পর সুরা আআলা পাঠ করলেন। এরপর রুকু ও সিজদা করলেন। দ্বিতীয় রাকাতে ফাতিহা ও কাফিরূন পাঠ করলেন এবং রুকু-সিজদা করলেন। তৃতীয় রাকাতে ফাতিহা ও ইখলাস পাঠ করলেন। এরপর রুকুর আগে কুনূত পড়লেন।’ (কিতাবুল হুজ্জাহ ১/২০১; নাসবুর রায়াহ : ২/১২৪)
দোয়া কুনুতের ঐতিহাসিক ঘটনা
আহমদ বিন হাম্বল, মুহাম্মাদ ইবনে ইসা আত-তিরমিজি এবং আবু দাউদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, হাসান ইবনে আলী রা. এই দোয়াটি মুহাম্মাদের (সা.) কাছ থেকে শিখেছিলেন। দাউদ আরও বলেছেন যখন মুসলমানদের ওপর কোনো বিপদ অথবা বিপর্যয় আসতো তখন মুহাম্মদ (সা.) দোয়া কুনুত পড়তেন।
দোয়ায়ে কুনুতের বদলে সুরা ইখলাস পড়া যাবে কি?
দোয়ায়ে কুনুত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর কাছে দোয়া করা। এ ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ দোয়া ‘আল্লাহুম্মা ইন্না নাসতাঈনুকা’ ছাড়া একই মর্মার্থের অন্য যেকোনো দোয়া পড়লেও বিশুদ্ধভাবে নামাজ আদায় হয়ে যাবে। যেমন ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনইয়া’ বা এই জাতীয় দোয়া পড়া। কেউ যদি এটা না পারে তাহলে তিনবার ‘আল্লাহুম্মাগফিরলি’ কিংবা তিনবার ‘ইয়া রব’ পড়লেও নামাজ হয়ে যাবে। তবে প্রসিদ্ধ দোয়াটি পড়া সুন্নত এবং সর্বোত্তম। আহসানুল ফতোয়া : ৩/৪৪৯
দোয়ায়ে কুনুতের মর্মার্থ এবং সুরা ইখলাসের মর্মার্থ ভিন্ন ভিন্ন। তাই দোয়ায়ে কুনুতের বদলে সুরা ইখলাস না পড়া। কেননা এই দোয়া পড়া সুন্নত। আর ইচ্ছাকৃতভাবে সুন্নত ত্যাগ করা গোনাহ।
বিতরের নামাজে দোয়া কুনুত না পড়লেও সমস্যা নেই, এটা কি ঠিক?
বিতরের সালাতের মধ্যে দোয়া কুনুত সুন্নাহ। যদি কেউ পড়ে, তাহলে তিনি দোয়া পড়লেন। আর যদি কেউ মনে করেন যে আমি দোয়া পড়ব না, শুধু এক রাকাত পড়ে শেষ করে দেব, তাহলেও এটি জায়েজ রয়েছে। সালফে সালেহীনগণ দোয়া কুনুতকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে একদল ওলামায়ে কেরাম এটাকে সুন্নাহ, আবার কেউ কেউ এটাকে ওয়াজিব বলেছেন। তবে ওয়াজিবের বক্তব্যটি সনদের দিক থেকে দুর্বল। কেউ যদি দোয়া কুনুত না জানেন, তাহলে তিনি যেকোনো ধরনের দোয়া পড়তে পারবেন। সুরা ইখলাস তিনবার পড়ার ব্যাপারে কোনো হাদিস সাব্যস্ত হয়নি। আর যদি কোনো দোয়া জানা না থাকে, তাহলে তিনি তাসবিহ ও তাকবির করবেন।
দোয়া কুনুত কখন পড়বে
ইমাম আবু হানিফা রহ., ইমাম মালিক ও ইমাম শাফেয়ি রহ. প্রমুখ ইমামের সিদ্ধান্ত হলো, ‘দোয়া কুনুত সর্বদা পড়তে হবে। তবে ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতে, তা শুধু বিতর নামাজে পড়তে হবে। ইমাম মালেক ও শাফেয়ি রহ.-এর মতে তা ফজর নাসাজে পড়বে। ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, দোয়া কুনুত বিতির নামাজের শেষ রাকাতে রুকুর আগে পড়বে।
দোয়া কুনুত পাঠের ফজিলত
দোয়া কুনুত ৩য় রাকাতে সুরা ফাতিহা ও সুরা মিলানোর পর তাকবির বলে হাত উঠিয়ে তারপর হাত বেঁধে রুকুর আগে পড়তে হয়।
হযরত আসিমুল আহওয়াল রহ. বলেন, ‘আমি হযরত আনাস রা.কে নামাজে দোয়া কুনুত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, হ্যাঁ, নামাজে দোয়া কুনুত পড়বে। আমি বললাম, রুকুর আগে না পরে? তিনি বললেন, রুকুর আগে। আমি বললাম, অমুক আমাকে আপনার সম্পর্কে খবর দিয়েছে যে, আপনি বলেছেন রুকুর পরে। তিনি বললেন, সে মিথ্যা বলেছে। রাসুলুল্লাহ সা. রুকুর পরে মাত্র এক মাস দোয়া কুনুত পড়েছেন। (বুখারি ৩৭৯৬)
হজরত আহমদ বিন হাম্বল, মুহাম্মাদ ইবনে ইসা আত-তিরমিজি ও আবু দাউদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, হাসান ইবনে আলী রা. এই দোয়াটি মুহাম্মদ সা.-এর কাছ থেকে শিখেছিলেন। ইমাম আবু দাউদ রহ. আরও বলেন যখন মুসলমানদের ওপর কোনো বিপদ অথবা বিপর্যয় আসতো তখন রাসূল সা. দোয়া কুনুত পড়তেন।